ঈদ সংখ্যা ২০২৫: সেই সময়ের প্রেম- নাসিম সাহনিক

2025-03-29 17:02:59 সাহিত্য
ঈদ সংখ্যা ২০২৫: সেই সময়ের প্রেম- নাসিম সাহনিক

           ১৯০০ সালের ঢাকা। বুড়িগঙ্গার তীরে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে আহসান মঞ্জিল। ঢাকার নবাবদের ঐশ্বর্য ও জাঁকজমকের প্রতীক এই প্রাসাদ। শহরের আরেকপ্রান্তে, বাংলাবাজারের এক সম্ভ্রান্ত ব্যবসায়ী পরিবারের সন্তান নাসির বড় হচ্ছেন বর্ণাঢ্য পরিবেশে। তাঁর বাবা ছিলেন সুপরিচিত ব্যবসায়ী, ঢাকার বড় বড় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে যার ওঠাবসা। নাসিরের জীবন ছিল বিলাসিতায় ভরা, কিন্তু তার মন পড়ে ছিল সাহিত্যে আর রোমাঞ্চে। ইউরোপীয় সাহিত্য পড়তে পড়তে তিনি যেন অন্য এক জগতে হারিয়ে যেতেন। একদিন আহসান মঞ্জিলে নবাবের আমন্ত্রণে এক ফরাসি অতিথি আসেন—মাদাম এলিজা। তাঁর স্বচ্ছ নীলচে চোখ আর সোনালি চুল যেন এক নতুন জগৎ খুলে দিল নাসিরের সামনে। প্রথম দেখাতেই নাসিরের মনে ঝড় ওঠে। এলিজাও নাসিরের বুদ্ধিমত্তা ও সৌজন্যে আকৃষ্ট হন। আহসান মঞ্জিলের বাগানে একদিন সন্ধ্যায় তাদের প্রথম দীর্ঘ আলাপ হয়, সেখান থেকেই শুরু হয় এক নিষিদ্ধ প্রেমের গল্প। অন্যদিকে, নাসিরের ইংরেজি শিক্ষক এডিথ ব্রাউন ছিলেন এক আকর্ষণীয় ইংরেজ মহিলা। ঢাকা কলেজে পড়ানোর পাশাপাশি তিনি সাহিত্য ও রাজনীতিতে আগ্রহী ছিলেন। নাসিরের প্রতিভা ও তার কবিত্বময় ভাষা এডিথকে মুগ্ধ করেছিল। ধীরে ধীরে তাদের সম্পর্ক গভীর হয়। নাসির কখনো এলিজার মোহে বিভোর থাকতেন, আবার কখনো এডিথের প্রখর বুদ্ধিমত্তা তাকে টানত। কিন্তু এই দুটি সম্পর্কই ছিল বাইরের দুনিয়ার। নাসিরকে একনিষ্ঠভাবে ভালোবাসত একজন, যার নাম সুমনা। বাংলাবাজারের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের মেয়ে সে। ছোটবেলা থেকেই নাসিরের প্রতি তার ছিল গভীর অনুরাগ। কিন্তু নাসিরের চোখ কখনো তার দিকে যায়নি। সে তো ব্যস্ত ছিল ইউরোপীয় রমণীদের প্রেমে। একদিন আহসান মঞ্জিলের এক পার্টিতে এলিজা ও এডিথ দুজনেই উপস্থিত ছিল। সুমনাও ছিল সেখানে, তবে দূর থেকে নীরবে নাসিরকে দেখছিল। সেই রাতেই নাসির বুঝতে পারে, দুই বিদেশিনীর প্রতি তার মোহ কেবলই আকর্ষণ, কিন্তু প্রকৃত ভালোবাসা কে যেন অন্য কেউ দিতে পারে। কিন্তু ততদিনে সময় চলে গেছে। এলিজা ফিরে গেছে ফ্রান্সে, এডিথও তার ব্রিটিশ অভিজাত সমাজে ফিরে গেছে। একদিন নাসির যখন বাংলাবাজারের গলিতে হাঁটছিল, তখন সে সুমনাকে দেখতে পায়। চোখে প্রশ্ন, ঠোঁটে নীরবতা। নাসির এবার তার দিকে তাকায়, সত্যিকারের প্রথমবারের মতো। কিন্তু সুমনা এবার আর থামে না। সে হেঁটে চলে যায় অন্ধকারের দিকে, যেখানে নাসিরের জন্য কোনো অপেক্ষা ছিল না। নাসির থমকে দাঁড়িয়ে রইল বাংলাবাজারের সেই গলির মোড়ে। সুমনার চলে যাওয়া যেন তার হৃদয়ে এক শূন্যতার সৃষ্টি করল। এতদিন সে যাকে অবহেলা করেছে, যার ভালোবাসাকে তুচ্ছ ভেবেছে, আজ সে-ই তাকে ছেড়ে চলে গেল। বাড়ি ফিরে নাসিরের মন পড়ে রইল পুরোনো স্মৃতির পাতায়। এলিজার হাসি, এডিথের প্রজ্ঞা—সবকিছুই যেন আজ অর্থহীন মনে হচ্ছে। ফরাসি এবং ইংরেজ নারীর সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিল কেবল মোহ, এক ধরণের বিলাসিতা। কিন্তু সুমনা? সে তো নাসিরের অস্তিত্বেরই অংশ ছিল, সে তো ছিল তার নিজের মাটি, তার নিজের শহরের মেয়ে।নাসিরের মনে পড়ল শৈশবের কথা। সুমনার সাথে তার কত খুনসুটি, আহসান মঞ্জিলের পুকুরপাড়ে বসে গল্প শোনা, বাংলাবাজারের সরু গলিতে লুকোচুরি খেলা। তখন সে জানত না যে এই মেয়েটি একদিন তার হৃদয়ের গভীরে শেকড় গেড়ে বসবে।  

২. 

পরদিন নাসির সুমনাকে খুঁজতে বেরোল। তার বাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়াল, কিন্তু সুমনা দেখা করতে চাইল না। তার বাবা স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন, “নাসির সাহেব, আপনি বড় ব্যবসায়ীর ছেলে। আপনার জন্য বড়লোকদের কন্যারা অপেক্ষা করছে। আমাদের সুমনার মতো সাধারণ মেয়ে আপনার উপযুক্ত নয়।” নাসির বুঝতে পারল, সে অনেক দেরি করে ফেলেছে। তার বিলাসী জীবনের মোহে সে যাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসতে পারত, তাকেই সে হারিয়ে ফেলেছে। কয়েক মাস পর খবর এল, সুমনার বিয়ে ঠিক হয়েছে। এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের ছেলের সঙ্গে, যে কলকাতায় চাকরি করে। বিয়ের আগের রাতে নাসির শেষবারের মতো সুমনাকে দেখতে গেল। জানালার ধারে দাঁড়িয়ে থাকা সুমনার চোখে জল, কিন্তু মুখে কঠিন সংযম। নাসির কাঁপা কণ্ঠে বলল, “তুমি কি একবারও আমাকে ক্ষমা করতে পারবে?” সুমনা কিছুক্ষণ নীরব থেকে বলল, “ক্ষমার প্রশ্ন আসে তখন, যখন অভিমান থাকে। আমি তোমার উপর আর অভিমানও করি না, নাসির।” এই কথাগুলো যেন নাসিরের হৃদয়কে টুকরো টুকরো করে দিল।

 ৩. 

সুমনার বিয়ে হয়ে গেল, সে চলে গেল কলকাতায়। আর নাসির? সে তার বাবার ব্যবসার দায়িত্ব নিতে লাগল, কিন্তু সেই আগের নাসির আর নেই। আহসান মঞ্জিলের আলো-ঝলমলে পার্টিগুলোতে সে আর আগের মতো উজ্জ্বল থাকে না, ফরাসি সাহিত্যের বইগুলো আর তার মোহ জাগায় না। রাতের ঢাকার নীরব আকাশের নিচে একদিন বুড়িগঙ্গার পাড়ে দাঁড়িয়ে নাসির দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, "ভালোবাসা কাছে থাকলেও আমরা তা বুঝতে পারি না, যখন বুঝি তখন তা অনেক দূরে চলে যায়।" নাসিরের জীবন বদলে গেছে, কিন্তু সময় কারও জন্য থেমে থাকে না। বাবার ব্যবসার দায়িত্ব নিলেও তার মন কোথাও যেন শূন্য হয়ে আছে। বাংলাবাজারের সেই চেনা গলি, আহসান মঞ্জিলের বিলাসিতা, বুড়িগঙ্গার ধারে নীরব সন্ধ্যা—সবকিছুই আগের মতো, কিন্তু তার হৃদয়ে এক অপূর্ণতার ব্যথা যেন চিরস্থায়ী হয়ে গেছে। সুমনা চলে যাওয়ার পর নাসির অনেকবার ভেবেছে, যদি সময়কে ফেরানো যেত! যদি সে এলিজা বা এডিথের মোহে না ডুবে গিয়ে সুমনার ভালোবাসা বুঝতে পারত! কিন্তু বাস্তবতা ছিল কঠিন এবং জীবনে অতীতকে ফিরে পাওয়ার সুযোগ একবারই আসে—যদি কেউ তা গ্রহণ করতে জানে।

৪.

 একদিন নাসির খবর পেল, কলকাতায় সুমনার স্বামী গুরুতর অসুস্থ। কিছুদিন পরেই আরও একটি দুঃসংবাদ এল—সুমনা বিধবা হয়েছে। সে এখন কলকাতায় এক দূর সম্পর্কের আত্মীয়ের বাড়িতে থাকে, সমাজ তাকে বিধবার কঠিন নিয়মের মধ্যে বেঁধে ফেলেছে। নাসিরের মন আবার অস্থির হয়ে উঠল। সে কি কলকাতায় গিয়ে সুমনাকে ফিরিয়ে আনবে? সমাজ কি তাকে তা করতে দেবে? নাকি তার নিজের পরিবারই তাকে প্রতিহত করবে? কয়েকদিন চিন্তা করে নাসির সিদ্ধান্ত নিল, সমাজের নিয়মের তোয়াক্কা না করেই সে সুমনাকে ফিরিয়ে আনবে। সে তার বাবার ব্যবসার কাজে কলকাতায় যাওয়ার নাম করে শহর ছাড়ল। কলকাতায় পৌঁছে অনেক খোঁজাখুঁজির পর সে সুমনার বর্তমান ঠিকানা পেল। যখন তার সঙ্গে দেখা হলো, সুমনা অবাক হয়ে গেল। বিধবার সাদা শাড়িতে মোড়া সে, যেন এক ক্লান্ত নদী, যে তার সমস্ত জল হারিয়ে ফেলেছে। “তুমি এখানে কেন এসেছো, নাসির?” তার কণ্ঠে ছিল একধরনের শূন্যতা। “তোমাকে নিতে এসেছি, সুমনা,” নাসির বলল দৃঢ় কণ্ঠে। সুমনা কিছুক্ষণ চুপ করে রইল, তারপর ধীরে ধীরে বলল, “এত দেরি করে কেন এলে, নাসির? যখন আমি অপেক্ষা করছিলাম, তখন তো তুমি আসোনি। এখন আমি আর ফিরে যেতে পারব না।” নাসির বোঝানোর চেষ্টা করল, “আমরা নতুন করে শুরু করতে পারি। কেউ আমাদের আটকাতে পারবে না।” কিন্তু সুমনার চোখে জল চিকচিক করল। সে জানত, সমাজ তাকে সহজে গ্রহণ করবে না। নাসিরের পরিবারও হয়তো তাকে মেনে নেবে না। দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে বলল, “ভালোবাসা যদি সত্যি হয়, তাহলে তা দূর থেকেও টিকে থাকে। তুমি আমাকে ভালোবেসো, কিন্তু আমাকে নিয়ে যাওয়ার কথা আর বোলো না।” নাসির কিছু বলার ভাষা খুঁজে পেল না। সে জানত, সুমনার ভালোবাসা অটুট, কিন্তু সমাজের শেকল তাকে বাঁধা দিয়েছে। নাসির একা ফিরে এল ঢাকা। বাংলাবাজারের সেই গলি, বুড়িগঙ্গার তীর, আহসান মঞ্জিলের আলো—সবকিছুই রয়ে গেল, শুধু নাসিরের হৃদয়েই এক শূন্যতা থেকে গেল। সে জানত, জীবনে কিছু ভালোবাসা পাওয়া যায় না, শুধু অনুভব করা যায়—আজীবন।

 

সম্পর্কিত আরো খবর  
img
বিস্তারিত পড়ুন >

আহসান মঞ্জিল জাদুঘরের ইতিহাস

নিজস্ব প্রতিবেদক.

বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর অযত্ন ও অপব্যবহারে আহসান মঞ্জিল ধ্বংসপ্রাপ্তির দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে। এমতাবস্থায় ১৯৭৪ সালে...

২৯ মার্চ ২০২৫ ০৪:৪৪ PM
img
বিস্তারিত পড়ুন >

আহসান মঞ্জিলের স্থাপত্যশৈলী কেমন?

নিজস্ব প্রতিবেদক.

এই প্রাসাদের ছাদের উপর সুন্দর একটি গম্বুজ আছে। এক সময় এই গম্বুজের চূড়াটি ছিল ঢাকা শহরের সর্বোচ্চ। মূল ভবনের বাইরে...

২৯ মার্চ ২০২৫ ০৪:৩৭ PM

img
বিস্তারিত পড়ুন >

ঈদ সংখ্যা২০২৩ : আনন্দপুর-নাসিম সাহনিক

                                                                                          আনন্দপুর

                                   ...

২৭ জুন ২০২৩ ০৬:২৫ AM
img
বিস্তারিত পড়ুন >

প্রেমের হাওয়া- নাসিম সাহনিক

১.
যশোরের একটি কলেজ। কেমিস্ট্রি ল্যাব পরীক্ষার জন্য সরঞ্জাম সাজাচ্ছে পিয়ন রাজ্জাক। পরীক্ষা পরিচালনা করবে শুভ্র। শুভ্র কেমিস্ট্রির লেকচারার।
শুভ্রঃ কেমিক্যালস সব রেডি আছে?
রাজ্জাকঃ...

১৮২৬৭ ঘন্টা ৫৮ মিনিট আগে
আপনি আরো পড়তে পারেন  
img
বিস্তারিত পড়ুন >

ব্যাচেলর ইন ট্রিপ চলচ্চিত্রে অনবদ্য অভিনয় লাবনি লাকির

বিশেষ প্রতিবেদক.

 ‘ব্যাচেলর ইন ট্রিপ‘ চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন মডেল ও অভিনেত্রী লাবনি লাকি।গোয়েন্দাগিরিখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা নাসিম সাহনিক পরিচালিত ও আম্মাজান ফিল্মস প্রযোজিত...

১৯ মে ২০২৫ ০৪:৩৪ PM
img
বিস্তারিত পড়ুন >

বাংলাদেশ-ইউএই ক্রিকেট সিরিজের টাইটেল স্পন্সর ওয়ালটন

স্টাফ রিপোর্টার.

শুরু হচ্ছে বাংলাদেশ-সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই) দুই ম্যাচের টি-টোয়েন্টি সিরিজ। এই সিরিজের টাইটেল স্পন্সর হয়েছে ক্রীড়াবান্ধব প্রতিষ্ঠান ওয়ালটন হাই টেক ইন্ডাস্ট্রিজ...

১৭ মে ২০২৫ ০৬:০৯ AM
img
বিস্তারিত পড়ুন >

কার্টআপ নিয়ে এলো “মে ম্যাডনেস” ক্যাম্পেইন

 

স্টাফ রিপোর্টার.

“কার্টআপ লিমিটেড”—ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম (ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স-এর অঙ্গ প্রতিষ্ঠান) নিয়ে এসেছে নতুন ক্যাম্পেইন “মে ম্যাডনেস”! এই ক্যাম্পেইন চলবে ১২ থেকে ১৮ মে, ২০২৫...

১৭ মে ২০২৫ ০৩:৫২ AM

img
বিস্তারিত পড়ুন >

ব্যাচেলর ইন ট্রিপ চলচ্চিত্রটিতে অভিজ্ঞ ও মেধাবী নতুন শিল্পীদের সমন্বয় ঘটেছে

বিনোদন প্রতিবেদক.

 চলচ্চিত্র নির্মাতা  নাসিম সাহনিকের আসন্ন চলচ্চিত্র ‘ব্যাচেলর ইন ট্রিপ‘। বেঙ্গলিভয়েস.কমের সাথে ব্যাচেলর ইন ট্রিপ ও অন্যান্য প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলেছেন এই...

০২ মে ২০২৫ ০২:২০ PM
img
বিস্তারিত পড়ুন >

বাড়ছে জংলির হল সংখ্যা

 বিনোদন প্রতিবেদক.

 মুক্তির ৪র্থ সপ্তাহে এসে ‘জংলি‘র শো বেড়েছে। আর দর্শকও ‘জংলি‘কে ভালোবাসা দিচ্ছে। ফলস্বরূপ, ছুটির দিনে ‘জংলি‘ আবারও সিঙ্গেল ডে হাইয়েস্ট গ্রস কালেকশন তুলে নিলো।...

২৬ এপ্রিল ২০২৫ ১১:৩২ AM
img
বিস্তারিত পড়ুন >

অভিভাবকরা সাবধান! শিশুদের মধ্যেই বাড়ছে কিডনি রোগ

হু হু করে বাড়ছে শিশুদের কিডনি সমস্যা: সচেতন না হলে বিপদ বাড়বে!

 প্রকাশ: ১০ এপ্রিল ২০২৫ | প্রতিবেদক: Bengalivoices স্বাস্থ্য ডেস্ক

দেশে দিন দিন শিশুর কিডনির সমস্যা আশঙ্কাজনক হারে...

১০ এপ্রিল ২০২৫ ০৬:০১ AM
পৃষ্ঠাসমূহ